ভালুকা প্রতিদিন:
মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তার পক্ষে সততার সাথে নিয়মের মধ্যে থেকে কাজ করলে যে সংখ্যক মানুষ খুশি থাকবেন তার থেকে বেশি মানুষ অখুশি বা অসন্তুষ্ট থাকবে এটাই স্বাভাবিক…
ফেসবুক বোদ্ধারা দুদিন পর পর দেখবেন এডমিন অফিসার দের কারণে হয়রানি হচ্ছে এই স্তবক নানা মোড়কে গাইবেন…
আমি কিছু প্র্যাক্টিক্যাল
উদাহরণে যাই….
UNO হিসেবে আমার কাছে যে ধরণের মানুষ সবথেকে বেশি আসে-
১) জন্মনিবন্ধন সনদ সংশোধন: ৮০-৯০% ভুয়া জন্মতারিখে পাসপোর্ট করিয়ে বাইরে গিয়েছেন। ধরেন কোন কোম্পানি তে লোক লাগবে ১৮ বছরের, যার বয়স ১৫ সেও দালাল দিয়ে পাসপোর্ট করিয়ে ১৮ বানিয়ে বাইরে গেছে, এখন পরে সে পাসপোর্ট যখন রিনিউ করা লাগবে সেটা যখন অনলাইন বার্থ সার্টিফিকেটের সাথে লিংকড, তার জন্মতারিখ সে বদলাতে আসে…
এখন আপনি দেখলেন তার এই ডকুমেন্ট কারেকশন করবেন যার বেসিসে সেটা ভিন্ন অথবা তার কোন শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ নেই, আপনি কী ভাবে তার এই সনদ সংশোধন করে দিবেন? মানে মিথ্যা কে জায়েজ করে দিবেন?
এই মিথ্যা জায়েজ করা যায় না বলেই – ইউএনও অফিস/এডমিন ক্যাডার হয়রানি করতেছে…দিনে যদি ২০ জনের কাজ করতে পারি, ৮০ জনের টাই করা যায় না, রিজেকট হয়। লোকে গালি দিবে যখন তার গলদ বা দুই নম্বুরির কথা কিন্তু বলবেই না।
২) প্রচুর লোকজন আসে জায়গা জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিরসনে…ভাইএ ভাই এ দ্বন্দ্ব। কেউ কারও ৪ আঙ্গুল টু ৪ হাত জায়গা ছাড়ে না বলে একে অন্যের মাথা ফাটাচ্ছে… ইউএনও র কাছে এসে বলে সরকারি সার্ভেয়ার দিয়ে তাদের জমি মাপায় দিয়ে ‘রায়’ দিয়ে দেয়াতে…
সরকারি সার্ভেয়ার দিয়ে ব্যক্তিগত জমি মাপানো নিষিদ্ধ আবার ইউএনও র অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব সালিশী রায় দেয়া ও বাস্তবায়ন করা র আইনী ভিত্তি দুর্বল…এসবের জন্য দেওয়ানী ও ফৌজদারি আদালতে যথাযথ ধারা রয়েছে… কিন্তু মানুষ এক্সপেক্ট করবে ইউএনও X ব্যক্তির পক্ষ নিয়ে অপর পক্ষ Y কে রায় মানতে বাধ্য করাবে নইলে জেলে দিবে… অর্থাত ক্ষমতার অপব্যবহার করাবে এবং তার নিজের ফেভারে গেলে সেই ইউএনও / এসিল্যান্ড ভালো
৩) সরকারি টি আর,কাবিখা,কাবিটা কিংবা এডিপি র যা বরাদ্দ আসে তা আদতে কিস্তি প্রতি এক এক ইউনিয়নে সব মিলে ১৫-২০ লক্ষ টাকা ( এলাকাভেদে ভিন্ন হয়)…কিন্তু ওই এলাকার রাস্তাঘাট, পুকুরের গাইডওয়াল, ছোট ড্রেন, কালভার্ট করে দেয়া, স্কুলের মাঠ ভরাট, বেন্চ কিনে দেয়া, চাল মেরামত, দেয়াল করে দেয়া, মাদ্রাসার বাথরুম – এসব আবেদন এক এক ইউনিয়নে আসে ৪০-৪৫ টা করে ( এবার আমার এক ইউনিয়ন থেকে পেয়েছি ৭১ টা)…
এখন এই ১৫-২০ বা ধরি ২৫ লক্ষ টাকা দিয়েই কতগুলো কাজ কাজের মত করে করানো যায়? সর্বোচ্চ ১০-১২ টি…
ওই বাকি যাদের টা পারলেন না করতে তাদের চোখে আপনি খারাপ…
৪) টিসিবি, ভিজিএফ, ভিডব্লিউডি, ত্রাণের টিন- এসবের উপজেলাওয়ারী যা বরাদ্দ আপনার কাছে চাহিদা থাকে তার ৫ থেকে ১০ গুণ…এর মধ্যে এলাকায় আপনি একই রাজনৈতিক দলের একাধিক গ্রুপ পাবেন , কোন বিশেষ সময়ে বিশেষ চেতনাধারী লোক পাবেন, বিভিন্ন সহকর্মীর অনুরোধ থাকবে.. এসবের বিন্যাস সমাবেশ করে আপনি সেই একি রেশিও ই পাবেন – ৪ ভাগ অখুশি ১ ভাগ খুশি মানুষ…
এলাকায় ফুটপাথ দখল করে দোকান দিয়েছে, বাস কাউন্টার করেছে…উঠায় দিতে চাইবেন- কোন একটা মিথ্যা গছায় দিবে….মাটি কেটে জমি নষ্ট করতেছে, ট্রাক্টর চালিয়ে হেরিংবোন বা সিসি রাস্তা ভাঙতেছে…আপনি এদের বিরুদ্ধে ফাইট করবেন মানে আপনি খারাপ..আপনার জমি র মিউটেশন এর আবেদনে অস্পষ্টতা বা কাগজে সমস্যা..নামজারি বাতিল হলে এসিল্যান্ড খারাপ হবে… সরকারি জমি নিজের নামে রেকর্ড করিয়ে রেখেছেন, আইন মাফিক উদ্ধারের প্রচেষ্টা নিলে এসিল্যান্ড-ইউএনও খারাপ হবে…হাটবাজারের ইজারা পেয়েছেন, সময়ের মধ্যে টাকা জমা দিবেন না- ইউএনও খারাপ…
এলাকার নামকরা স্কুলে বাচ্চা লটারি বা পরীক্ষায় টিকে নাই…তদবির রক্ষা করে নিয়মের বাত্যয় না করলে ইউএনও খারাপ…
মোটের উপর আপনি যে ক’জন মানুষ কে প্রতিনিয়ত সন্তুষ্ট করতে পারবেন তার কয়েকগুণকে ফিরিয়ে দিতে হবে যদি আপনি নিয়মের মধ্যে চলেন। আর যদি নিয়ম ভাঙতে থাকেন, জনপ্রিয় হবেন তবে দীর্ঘ মেয়াদে ওই এলাকার তো ক্ষতি করবেন ই পরের অফিসারদের জন্যেও সর্বনাশ করে যাবেন…